প্রতিপদার্থ, সময়ের বিপরীতমুখীতা এবং আয়না মহাবিশ্ব

প্রতিপদার্থ, সময়ের বিপরীতমুখীতা এবং আয়না মহাবিশ্ব

প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী মহাবিশ্ব সবসময় ছিলোনা। একসময় এর আবির্ভাব হয়েছে শুন্য থেকে (এক্স-নিহিলো)। অনেকে এই আবির্ভাব হওয়ার সময়টাকে বিগব্যাং আখ্যা দিয়ে থাকেন।

আবার অনেকে বিগব্যাং ই যে মহাবিশ্বের শুরু তা মানতে নারাজ। তার যথেষ্ট যৌক্তিক কারণও আছে। এই যেমন কোত্থেকে এলো এই মহাবিশ্ব? এর আগে কি ছিলো ইত্যাদি ইত্যাদি।

এগুলোর অনেকপ্রকার উত্তরই অনেকে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কেউ বলেন মাল্টিভার্স থিওরির কথা, আবার কেউ কেউ (রজার পেনরোজ) বলেন সাইক্লিক ইউনিভার্সের কথা। অর্থাৎ মহাবিশ্বের সৃষ্টি বা ধ্বংস নাই, বরং বিগব্যাং এ এক মহাবিশ্বের শেষ হয় এবং আরেক মহাবিশ্বের শুরু হয়। এবং মাঝখানের এই সময়টাকে ইয়ন বলা হয়।

যাইহোক, সেন্সিক্যাল জিনিস। অনেক ধর্মের ফিলোসফির সাথেই মিলে যায়। কিন্তু ধর্মের মতোই এই বিষয়টাও অপ্রমাণ যোগ্য বিশ্বাসের বিষয়ের মতোই রয়ে গেছে।

কিন্তু সমস্যা আসোলে সেই যায়গাতেও না। সমস্যা হলো এসব মাল্টিভার্স থিওরি কিংবা সাইক্লিক কসমোলজি শুধুমাত্র সমস্যাটাকে একধাপ পিছনে টেনে রাখে, সমাধান দেয়না।

আচ্ছা সমস্যাটা কি? সমস্যাটা কল্পনা করাটা একটু… না, বেশ কঠিন। এক্স-নিহিলো ক্রিয়েশনিজম অনুযায়ী একসময় কিছুই ছিলোনা, অতীতে কোনো একসময় সবকিছু এমনকি সময়ও সৃষ্টি হইছে। বেশ।
তাহলে সবকিছু আসলো কোত্থেকে বা কিভাবে?

আর সাইক্লিক কসমোলজি বা ইনফাইনাইট মাল্টিভার্স থিওরি মানলে তো এই শুরুর সমস্য থাকেনা।
না। তা নয়। যেমন ইনফাইনাইট মাল্টিভার্স এর ক্ষেত্রে দুইটা সমস্যা: ১) একচুয়াল ইনফিনিটি (বাস্তবতায় এক্সিস্ট করে কিনা) ২) এই মাল্টিভার্সই বা এলো কোত্থেকে, কিভাবে?

আবার সাইক্লিক কসমোলজির ক্ষেত্রে ইনিশিয়াল যেই জিনিসটা যেটা ক্রমাগত কন্ট্রাক্টিং & এক্সপান্ডিং হচ্ছে তার উৎপত্তি কোত্থেকে কিভাবে হলো? আর এই ইয়ন বিষয়টা একটা বৃহত্তর কন্টিনিউয়াস সময়ের মধ্যেই পড়ছে। যদিওবা অতীত এবং ভবিষ্যৎ সিংগুলারিটির জন্য এক ইয়ন থেকে আরেক ইয়নে যাওয়া যায়না জোর করে।

তাহলে? তাহলে যেটা দাঁড়ায় সেটা হলো সৃষ্টি তত্ত্বগুলোর মধ্যে সবচাইতে ইলিগ্যান্ট তত্ত্ব হচ্ছে বর্তমান স্ট্যান্ডার্ড মডেল বা ল্যাম্বডা-সিডিএম মডেল। সমস্যা ছাড়া নয় অবশ্যই। এর নামের মধ্যেই দুইটা অমিমাংসিত বিষয় রয়ে গেছে: ১) ডার্ক এনার্জি ( ল্যাম্বডা ) ২) ডার্ক ম্যাটার (সিডিএম)

যাইহোক, ম্যাটার ডার্ক ম্যাটার বাদেও আরেক ধরনের ম্যাটার আছে, সে হলো এন্টি ম্যাটার। আর এই জিনিস আবার ডার্ক ম্যাটারের মতো অমীমাংসিত না, প্রমাণিত জিনিস (জিনিস বলাটা যদিওবা ইনএপ্রোপ্রিয়েট)।

আইডিয়াটা সংক্ষেপে এমন: মহাবিশ্ব একসময় ছিলোনা। বস্তু ছিলোনা বিধায় সময়ও ছিলোনা। ভর শক্তির সমষ্টি ছিলো শুন্য।
তিনি কইলেন “এহি অর”। তারপর যা হওয়ার হইলো।

কেমনে শুন্য ভরশক্তির তে এতোকিছু হইলো আসেন ব্যাখ্যা করি।
ধরেন সমুদ্র সৈকতে এক বালক খেলতেছে, ওই যতীন্দ্র মোহন বাগচীর “সিন্ধু তীরে খেলে শিশু বালু লয়ে খেলা” আরকি।
বিষয়টা কল্পনা করেন। শিশুটি খেলার আগে তীরের ওই যায়গাটা সমতল ছিলো। এই সমতলতার পরিমাপকে আমরা শূন্যতা বলতে পারি। এখন বালক এসে সেই সমতল বালুকাবেলা থেকে গর্ত করে বালু তুলে বিভিন্ন কিছু বানাতে লাগলো। ফলে একদিকে গর্ত, অন্যদিকে উঁচু ঘরবাড়ি, তাইতো?

তারমানে শুন্যতা হতে কিছু একটা হচ্ছে। কিন্তু এটা শুধুমাত্র একমুখী হওয়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ গর্তের সৃষ্টি না করে বালুকাবেলায় ঘরবাড়ি সৃষ্টি সম্ভব নয়।

আচ্ছা গর্তের পরিমাপ কতো?
উত্তোলনকৃত বালুর সমান।
অর্থাৎ গর্ত করে তোলা বালুর ঢিবি আর গর্তের পরিমাপ একই। ওই বালু দিয়েই আবার গর্ত পূরণ করে সমতল (শুন্য) করা যাবে।

এর সাথে আমাদের আলোচনার সম্পর্ক কি?
ধরেন তো বালুর ঢিবি হচ্ছে ম্যাটার (রেগুলার, ডার্ক)।
আর ওই বালু তোলার ফলে হওয়া গর্ত হচ্ছে এন্টিম্যাটার।

আচ্ছা এইটা কি জিনিস? আর এর অস্তিত্ব আছে?
হ্যাঁ। এর অস্তিত্ব প্রমাণিত। সহজ ভাষায় এন্টিম্যাটার হচ্ছে এন্টি পার্টিকেল দিয়ে তৈরি ম্যাটার।

এন্টিপার্টিকেল আবার কি?
এন্টিপার্টিকেল হলো পার্টিকেলের পেয়ার বা জোড়া (বালুকণার বিপরীতে হওয়া সমপরিমাণ গর্ত) যাদের চার্জ এবং স্পিন ছাড়া বাঁকি সব আইডেন্টিক্যাল।

এখন কাহিনী হচ্ছে ধারণা করা হয় যে বিগব্যাং এর সময় সমপরিমাণ ম্যাটার এবং এন্টিম্যাটার তৈরী হয়। কিন্তু বর্তমান বিশ্বের অবজারভেশন তা বলছেনা। দৃশ্যতই এই মহাবিশ্বে ম্যাটারের পরিমাণ এন্টিম্যাটারের চাইতে বেশি। তাহলে মিসিং এন্টিম্যাটার গেলো কই?
গর্ত। গর্তে। অর্থাৎ ধারণা করা হয় যে এই মহাবিশ্বের (বালুর ঢিবি) বিপরীতে এন্টিম্যাটার দিয়ে তৈরি এন্টিম্যাটার মহাবিশ্ব (ঢিবির সমপরিমান গর্ত) তৈরি হইছে।

তো সেই এন্টিম্যাটার মহাবিশ্বের মাহাত্ম্য কি?
আসোলে এটা নিয়েই লিখতে বসছিলাম। এই এন্টিম্যাটার ইউনিভার্সকে অনেকে বলছেন মিরর ইউনিভার্স। যাতে আমার কোনো সমস্যা নাই। আপনি যদি ডানহাতি হন তবে আপনার মিরর ইউনিভার্সের টুইন হবে বাঁহাতি। কিন্তু দেখা হলে ভুলেও হ্যাণ্ডশেক করতে যাবেননা। ধ্বংস হয়ে যাবেন।

ওকে! কিন্তু এই মিরর বা এন্টিম্যাটার ইউনিভার্স নিয়ে বিশাল একটা মিসকনসেপশন বা মিসইন্টারপ্রিটেশন আছে। আর তা হলো মিরর ইউনিভার্সে সময় বিপরীতমুখে চলে।
বলা বাহুল্য যে উপরের স্টেটমেন্ট টা শতভাগ সঠিক। মিরর ইউনিভার্সের সময় আমাদের ইউনিভার্সের সময়ের বিপরীত। অর্থাৎ এন্টিম্যাটার এর পাশাপাশি এন্টি টাইমও আছে।

কিন্তু ম্যাক্সিমাম ক্ষেত্রে দেখলাম এর ভুল ইন্টারপ্রিটেশন দেওয়া হচ্ছে।
কেউ কেউ বলছেন সেখানে সময় অতীতমূখী। আসোলে কি তাই?
আমরা কি সত্যিই মিরর ইউনিভার্সের সবকিছু অতীতের দিকে যেতে দেখবো? আমরা কি দেখবো ভাঙা কাঁচের গ্লাস জোড়া লাগতে? কিংবা ভিডিও ক্লিপ উল্টোদিকে চলতে?

উত্তর হচ্ছে, না! আমরা মোটেও তা দেখবোনা। ঘটনা আইডেন্টিক্যালই ঘটবে। যেমন আপনার টিভিতে সরাসরি মুভি দেখা আর আপনার ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় টিভির প্রতিফলনে মুভি দেখার এক্সপেরিয়েন্সে কজালিটি জনিত কোনো হেরফের হয়না।

মিরর ইউনিভার্সের বাসিন্দাদের কাছেও বিশেষ কিছু মনে হবেনা। আসলে তারা বুঝবেওনা যে তারা এন্টি ম্যাটার দিয়ে তৈরি। তাদের কাছে বরং আমরাই এন্টিম্যাটার দিয়ে তৈরি। উভয়ই সঠিক।

তাহলে সময়ের বিপরীতমুখীতার যে বেপারটা?
হ্যাঁ! সময় আমাদের বিপরীতেই চলে। আমাদের অতীতমূখে। কিন্তু সময়ের প্রবাহ একই। আমাদের অতীতের দিক, তাদের ভবিষ্যতের দিক। কিন্তু উভয়ই তাদের নিজনিজ ভবিষ্যতের দিকেই ধাবমান। হ্যাঁ তাদের অতীত আর আমাদের অতীত একই স্থানকালে মিলিত হয়।

বিষয়টা অনেকটা এরকম: আপনি আর আপনার বন্ধু আসাদগেটে আড্ডা মারার পর আসাদগেট মোড় থেকে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। একজন মিরপুর অভিমুখে, আরেকজন আজিমপুর অভিমুখে। আর কখনও মিলবেন না।

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

মন্তব্য করুন